নিজের ঘনিষ্ঠ গণ্ডির বাইরে তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না জেনারেল আব্দুরহমান চিয়ানি। কিছুদিন আগ পর্যন্তও তিনি নিজেরের প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ইউনিটের প্রধান ছিলেন। কিন্তু যার নিরাপত্তা রক্ষাই ছিল তার দায়িত্ব সেই প্রেসিডেন্ট মোহামেদ বাজুমকেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত করলেন।
গত ২৬শে জুলাই ক্ষমতা নিয়েই তিনি নিজেকে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর দি সেফগার্ড অব হোমল্যান্ড’ অর্থাৎ স্বদেশে রক্ষার এক পরিষদ গঠন করে নিজেকে তার প্রধান হিসাবে নিজের ঘোষণা করেন।
অন্যদিকে তার সাবেক বস এখন গৃহবন্দী। মি. বাজুম এখন মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ বাইরের দেশের নেতাদের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন। এছাড়া, তিনি একরকম বিচ্ছিন্ন।
আপোষের প্রস্তাব এখন পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন জেনারেল চিয়ানি। বাইরের দেশের প্রতিনিধিদের সাথে তিনি তেমন কথা বলছেন না। শুধু নাইজেরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং সেদেশের কানো প্রদেশের সাবেক আমির মোহাম্মদ সানুসি বুধবার তার সাথে দেখা করতে পেরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সোমবার নিজেরে যান, কিন্তু ৬২ বছরের এই জেনারেলের সাথে তিনি দেখা করতে পারেননি।
এমনকি পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ইকোওয়াসের একটি প্রতিনিধিদলকে বিমানবন্দরের নামতে দিলেও বাইরে বেরুতে দেওয়া হয়নি।
বুধবার ইকোওয়াস, জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের যৌথ একটি প্রতিনিধিদল বুধবার নিজেরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও সেনা সরকারের আপত্তির কারণে সেই সফর স্থগিত করা হয়।
একগুঁয়ে এবং আপোষহীন বলে জেনারেল চিয়ানির যে ভাবমূর্তি রয়েছে তার প্রকাশ তিনি প্রতি পদে পদে এখন করছেন।
খুলে বলছেন তার মনে কী রয়েছে। রোববার নতুন সেনা সরকার রাজধানী নিয়ামেতে বিশাল এক সমাবেশ করে, কিন্তু জেনারেল চিয়ানি তাতে যোগ দেননি। অভ্যুত্থানের পর শুধু তিনবার তিনি টিভির সামনে এসেছেন। কথা বলেছেন দু’বার। প্রথমবার নিজেকে নিজেরের নতুন নেতা হিসাবে ঘোষণা করেন। আরেকবার নিজেদের স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ দেন।
এমন আচরণের কারণ হতে পারে তিনিই নিজেই হয়তো জানেন না এই অভ্যুত্থানের পরিণতি কোনদিকে গড়াতে পারে।
ইকোওয়াস জোট যে সামরিক হস্তক্ষেপের যে হুমকি দিয়েছে তারা কি তা কার্যকরী করবে? নাকি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সামরিক জান্তাকে ক্রমে দুর্বল করে দেওয়ার পথ নেবে এই জোট?
ইকোওয়াসের মধ্যে এই দ্বিধার একটি কারণ হলো নাইজেরিয়াসহ জোটের বেশ কটি দেশ সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধী। জোটের বর্তমান চেয়ারম্যান, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু, সরাসরি বলে দিয়েছেন তিনি কূটনৈতিক পথে সংকটের নিরসন চান
তাছাড়া, নিজেরের অভ্যুত্থানের নেতারা সম্প্রতি দেখেছেন যে প্রতিবেশী মালি, বুর্কিনা ফাসো এবং গিনিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর বাইরে থেকে এ ধরণের হুমকি ধমকিতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। সেসব দেশের সেনা শাসকরা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন।
ফলে জে. চিয়ানিও হয়তো এ মুহূর্তে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেনা সরকার সাবেক অর্থমন্ত্রী আলি মাহামান লামিন জেইনিকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করেছে। এই নিয়োগের মাধ্যমে তারা ইঙ্গিত দিচ্ছে ভবিষ্যতে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে।
অনেক পর্যবেক্ষক আশংকা করছেন জাতিগত আরব মি. বাজুমকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিণতিতে নিজেরে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়ে যেতে পারে কিনা। তবে আধুনিক নিজেরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ, রেষারেষি এখন আগের চেয়ে অনেক কম। আশপাশের অনেক দেশের চাইতে এক্ষেত্রে নিজের অনেকটাই ব্যতিক্রমী।
তবে সাবেক তুুয়ারেগ বিদ্রোহী নেতা এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী রিসা আগ বোওলা মি. বাজুমকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে তিনি “প্রতিরোধ কাউন্সিল” নাম একটি পরিষদ গঠনের কথা বলেছেন। তবে জাতি-গোষ্ঠীর কোনো প্রসঙ্গ তিনি টানেননি।
সামরিক জান্তাও জাতিগত বিভেদ উসকে দেওয়ার কোনো পথ এখনও নেয়নি।
তবে জে. চিয়ানি বড় কোনো ঝুঁকি নিতে হয়তো পিছপা হবেননা। সামরিক অভ্যুত্থান এবং মি. বাজমুকে আটকে রাখার সিদ্ধান্তই ছিল বিশাল এক ঝুঁকি। এই কাজে ব্যর্থ হলে তাকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হতো।
এবং সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের সাথে দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল এবং সেইসাথে সেনা শাসকরা বিতর্কিত রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের সাহায্য চাইছেন বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ইকোওয়াস এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে আরো ক্রুদ্ধ করবে।
তার ৪০ বছরের পেশাদার সৈনিক জীবনে জে. চিয়ানি সেনেগাল, ফ্রান্স, মরোক্কো, মালি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর হয়ে আইভরি কোস্ট, সুদানের দারফুর এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে কাজ করেছেন। আইভরি কোস্টে ইকোওয়াস বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন। এবং জঙ্গি ইসলামী গোষ্ঠী বোকা হারামের মোকাবেলায় নিজের, চাদ, নাইজেরিয়া এবং ক্যামেরুনের যৌথ বাহিনীতেও কাজ করেছেন।
শান্তিরক্ষী যখন অভ্যুত্থানের নেতা
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে তিনি এখন সেই ইকোওয়াসেরই মুখোমুখি হয়েছেন।
তার দেশে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কম্যান্ডিং পদে ছিলেন জে. চিয়ানি। তবে তার দীর্ঘ এই সৈনিক জীবনে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়: ২০১১ সালে পদোন্নতি পেয়ে প্রেসিডেন্ট গার্ড বাহিনীর নেতৃত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত দেশে বা বিদেশে কখনই এমন কোনো উঁচু পদে তিনি ছিলেন না যেখানে তাকে জটিল কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে কোনো কৌশল তৈরির প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট হতে হয়েছে। সবসময়ই তিনি একবারেই পেশাদার সৈনিক হিসাবে তার ওপর ন্যস্ত সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করেছেন।
মি. বাজুমের পূর্বসূরি মাহমাদু ইসোফু যখন তাকে প্রেসিডেন্ট গার্ড বাহিনীর নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তখনও একরকম চুপই ছিলেন জে. চিয়ানি। নিজেরে জিহাদি তৎপরতা মোকাবেলার কৌশল নিয়ে দেশের ভেতর চলা বিতর্কে কখনই তার কাছ থেকে কিছু শোনা যায়নি।
বিশ্বস্ত বলে পরিচিত এবং চুপচাপ ধরণের এই সেনা কর্মকর্তা প্রেসিডেন্টের গার্ড বাহিনীর প্রধান হলেও প্রেসিডেন্টরা তাকে তেমন চিনতেননা। জানা যায় মি. বাজুম এবং তার পূর্বসুরি মি. ইসোফুর সাথে তার বেশ দূরত্ব ছিল। এমন গুজবও ছিল যে প্রেসিডেন্ট বাজুম তাকে জোর করে অবসরে পাঠাতে চলেছেন।
ফলে, ব্যক্তিগত অসন্তোষ তার ভেতরে দানা বাঁধছিল।
সাধারণ সৈনিক থেকে সেনাশাসক
জে. চিয়ানি নিজেরের সংখ্যাগরিষ্ঠ হাউসা জাতিগোষ্ঠীর। তিনি টিলাবেরি অঞ্চলের লোক। এই অঞ্চলটি বহুদিন ধরেই সেনাবাহিনীতে নিয়োগের প্রধান একটি এলাকা। কিন্তু শুরুতেই তিনি অফিসার হিসাবে ঢোকেননি। তেমন রাজনৈতিক যোগাযোগ তার ছিলনা। কষ্ট করে, নিজের চেষ্টায় এতদূর এগিয়েছেন।
মি. বাজুমের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটাই সত্যি। সাদামাটা পরিবার থেকে তিনি উঠে আসেন। ১৯৯০ এর দশকে রাজনীতিকে ঢোকার আগে তিনি একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন, তারপর জড়িত হন শ্রমিক রাজনীতিতে।
কিন্তু তারপরও জে. চিয়ানির সাথে মি. বাজুমের সম্পর্ক কখনই সহজ ছিলনা।
সাধারন একটি সৈনিক জীবন কাটালেও, জে. চিয়ানিকে এখন হঠাৎ করেই চরম এক রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সংকট সামলানোর দায় হাতে নিতে হয়েছে। ইচ্ছা করেই তিনি নিয়েছেন।
এবং যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সেনাবাহিনীতে এতদিন তার পক্ষে কাজ করেছে সেগুলোই তিনি ধরে রয়েছেন: ধৈর্য, নিজের ভাবনা খুব স্পষ্ট প্রকাশ না করা এবং আপোষে রাজী না হওয়া।
তবে নিজেরে বহু মানুষের মধ্যে ফ্রান্স বিরোধী যে মনোভাব শক্তভাবে বিরাজমান সেটিকে জে. চিয়ানি এবং এবং সামরিক জান্তা খুব সুকৌশলে কাজ লাগাচ্ছেন। এই জনসমর্থনের পর ভর করে ইকোওয়াস জোটের সাথে টক্করেও সাহস দেখাচ্ছেন তারা।
তবে নাইজেরিয়া এবং পশ্চিম আফ্রিকার অন্য দেশের সাথে টক্কর দেওয়ার এই অভিলাষের কারণে নিজেরের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার চাপ অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় তাতে আরো বেড়ে যেতে পারে। এখন জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসলেও তেমন পরিস্থিতি সামলানো জে. চিয়ানিকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলে দিতে পারে।
GIPHY App Key not set. Please check settings