বুর্কিনা ফাসো, গিনি, মালি এবং চাদের পর অতি সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকার আরেকটি দেশ নিজেরেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। সবগুলো দেশই ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ। যেটি লক্ষণীয় তা হলো, ১৯৯০ সাল থেকে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে যে ২৭টি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে তার ৭৮ শতাংশই হয়েছে সাবেক ফরাসী উপনিবেশগুলোতে।
ফলে, অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তোলেন পশ্চিম আফ্রিকার এই অস্থিরতার মূল দায় কি ফ্রান্সের? অথবা এই অঞ্চলটি কি এখনও ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসনের পরিণতি বহন করে চলেছে?
অভ্যুত্থান যারা ঘটান তারা এমন সন্দেহের জন্য আমাদের হয়তো বাহবা দেবেন। মালির সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা কর্নেল আবুলায়ে মাইগা গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা উগরে দিতে শুরু করেন। ফ্রান্স প্রসঙ্গে মি. মাইগা বলেন “নব্য-ঔপনিবেশিক, আধিপত্যবাদী” দেশটি “সার্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধ বর্জন করেছে” এবং মালির “পিঠে ছুরি মেরেছে।”
বুর্কিনা ফাসোতেও ফ্রান্স বিরোধী মনোভাব এখন তুঙ্গে। ফেব্রুয়ারিতে সেদেশের সামরিক সরকার ফরাসী সৈন্য মোতায়েন সম্পর্কিত দীর্ঘ দিনের চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে এক মাসের মধ্যে সমস্ত ফরাসী সৈন্যকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
মালি ও বুর্কিনা ফাসোর প্রতিবেশী দেশ নিজেরে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহামেদ বাজুমকে উৎখাতের পর যুক্তি দেয় তিনি ছিলেন ফ্রান্সের বসানো একটি পুতুল যার মূল লক্ষ্যই ছিল ফরাসী স্বার্থ রক্ষা।
শুধু তাই নয় নিজেরের সেনাশাসক জেনারেল আব্দুরহমান টিচিয়ানি ফ্রান্সের সাথে স্বাক্ষরিত পাঁচটি সামরিক চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন। অভ্যুত্থানের পর জনতা নিজেরে ফরাসী দূতাবাসেও হামলা চালিয়েছে।
তবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এসব রোষের পেছনে ঐতিহাসিক কিছু কারণও রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ফরাসীরা এসব দেশে এমন রাজনৈতিক পদ্ধতি চালু রেখেছিল যার প্রধান লক্ষ্যই ছিল সম্পদ কুক্ষিগত করা, এবং এই ব্যবস্থা বজায় রাখতে ফরাসীরা নির্যাতনমুলক বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছে।
ব্রিটেনও তাদের উপনিবেশগুলোতে একই কাজ করেছে, তবে ফরাসীরা যেটা করেছে তা হলো কাগজে-কলমে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পরও তারা তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোতে শক্ত অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সেই চেষ্টা এতটাই জোরালো যে অনেক সমালোচক বলেন ফ্রান্স এখনও তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে সরাসরি নাক গলাচ্ছে।
পশ্চিম আফ্রিকার নয়টি ফরাসী ভাষাভাষী দেশের সাতটিতেই এখনও সিএফএ ফ্রাঁ মুদ্রা চালু রয়েছে। এসব মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয় ইউরোর মূল্যমানের ভিত্তিতে। আফ্রিকান এসব মুদ্রার বিনিময় মূল্যের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয় ফ্রান্স।
সাবেক এসব উপনিবেশগুলোর অধিকাংশের সাথেই ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে যার আওতায় প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন দেশে ফ্রান্স-পন্থী অজনপ্রিয় রাজনীতিকদের ক্ষমতায় রাখতে ফরাসী সৈন্য মোতায়েন করা হচ্ছে।
এমন অনেক উদাহরণই রয়েছে যে ফ্রান্সের মদতে অনেক দুর্নীতিপরায়ণ এবং অত্যাচারী শাসক গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে, যেমন চাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবি বা বুর্কিনা ফাসোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্লেইজ কমপাওরে।
সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকায় যেসব সরকারপ্রধান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, তাদের সবাই ফ্রান্স-পন্থী হিসাবে পরিচিত, যদিও তাদের রক্ষায় ফ্রান্স সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি।
যে বিষয়টি আরো খারাপ তা হলো – ফ্রান্সের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আফ্রিকায় তাদের মিত্রদের ঘনিষ্ঠতা যার সাথে প্রায়ই দুর্নীতির নানা কেলেঙ্কারি জড়িত। এই সম্পর্কের ওপর ভর করে আফ্রিকায় একটি অভিজাত শ্রেণীর জন্ম হয়েছে যারা তাদের জনগণের স্বার্থ, অধিকারের তোয়াক্কা করেনা।
নব্য ঔপনিবেশিক এই সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত ফরাসী অর্থনীতিবিদ ফ্রাঁসোয়া-জাভিয়ের ভারসাভে ‘ফ্রসাফ্রিক’ নামে একটি শব্দ উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেছেন এই সম্পর্কের অন্তরালে রয়েছে “ফরাসী রাজনীতি এবং অর্থনীতির উঁচু স্তরের কিছু মানুষের গোপন অপরাধ প্রবণতা।“ তিনি মনে করেন, এই সম্পর্কের কারণে আফ্রিকার এই দরিদ্র দেশগুলো থেকে প্রচুর টাকা-পয়সা, সম্পদ চুরি হচ্ছে, পাচার হচ্ছে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ফরাসী সরকারগুলো এ ধরণের সম্পর্কের সাথে দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু আফ্রিকায় ফ্রান্সের ব্যবসায়িক স্বার্থ বহুদিন ধরেই একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এই সম্পর্কের সাথে দুর্নীতির নানা কেলেঙ্কারির অভিযোগ জড়িত।
সহজেই বোঝা যায় কেন সম্প্রতি একজন নাইজিরিয় বিবিসির কাছে মন্তব্য করেছিলেন: “ছোটবেলা থেকেই আমি ফ্রান্সের বিরোধী…আমাদের যেসব মূল্যবান সম্পদ রয়েছে তার সবই তারা আত্মসাৎ করেছে – ইউরেনিয়াম, পেট্রল, স্বর্ণ।”
ফ্রান্সের মিত্র রাজনীতিকরা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন এসব কেলেঙ্কারি প্রায়ই ঢাকা পড়ে থাকে। বিনিময়ে, ফ্রান্সের সামরিক সহযোগিতায় সেসব শাসকরা স্থিতিশীলতা রাখার সুযোগ পায়।
তবে সাম্প্রতিক বেশ কবছর ধরে ফ্রান্স ও পশ্চিমাদের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সক্ষমতা কমছে। সেইসাথে, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খোলাখুলি সমালোচনাও বাড়ছে।
আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে কট্টর ইসলামপন্থীদের বিদ্রোহ দমনে ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমা কিছু দেশ প্রচুর অর্থ সাহায্য দিয়েছে, সেনা মোতায়েন করেছে, কিন্তু অঞ্চলের সরকারগুলো কোনোমতেই বিশাল এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না।
ফলে, মালি এবং বুর্কিনা ফাসোতে সরকারগুলো চাপে পড়েছে। এই দেশ দুটোতে এমন মনোভাব বাড়ছে যে ফরাসীদের সাহায্যে তাদের ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি হচ্ছে। আর জনমনে এই ক্ষোভের কারণে সামরিক নেতারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সাহস পাচ্ছে। তারা ভাবছে জনগণ তাদের সমর্থন করবে।
তবে ফ্রান্সই যে একমাত্র ঔপনিবেশিক শক্তি যারা সাবেক উপনিবেশগুলোতে স্বৈরাচারী নেতাদের মদত দিয়েছে তা নয়।
শীতল যুদ্ধ চলার সময়, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র আনুগত্যের বিনিময়ে কেনিয়ার ড্যানিয়েল আরপ মই এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মবুতু সেসো সেকোর মত অনেক স্বৈরাচারী শাসককে মদত দিয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে আফ্রিকার যে চারটি দেশে সবচেয়ে বেশি সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে– নাইজেরিয়া (৮), ঘানা (১০), সিয়েরা লিওন (১০) এবং সুদান (১৭) – সবগুলোই ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।
তবে সাবেক ফরাসী উপনিবেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে সেনা অভ্যুত্থান হচ্ছে তার পেছনে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে “অভূতপূর্ব” নিরাপত্তাহীনতার যোগাযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, “সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহিংস তৎপরতা, এবং অপরাধী চক্রের তৎপরতার” কারণে বেসামরিক সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বেড়েছে।
গত তিন বছরে যেসব সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে তার পেছনে কাজ করেছে প্রধানত অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংকট। মালিতে অভ্যুত্থানের পেছনে যেসব কারণ ছিল তা হলো – ২০১১ সালে লিবিয়া অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার পর সেখান থেকে প্রচুর সশস্ত্র কট্টরপন্থীর প্রবেশ, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এবং রাজধানীতে সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ।
নিজেরে প্রেসিডেন্ট বাজুম সেনা নেতৃত্বে সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং জেনারেল টিচিয়ানিকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। ফলে, নিজেরের সার্বভৌমত্ব রক্ষা বা সেদেশের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য বদল ঐ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিলনা। সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব তাদের সুযোগ-সুবিধা, প্রভাব অব্যাহত রাখার লক্ষ্যেই অভ্যুত্থান করেছে।
অনেক নতুন সামরিক সরকারের মধ্যে বিদেশী মিত্র বদলের প্রবণতাও চোখে পড়ছে। যেমন, সম্প্রতি সেন্ট পিটার্সবুর্গে রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ বৈঠকে বুর্কিনা ফাসো এবং মালি ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
সবসময়ই বাইরের বিশ্বের সাথে মৈত্রীর সম্পর্কের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আফ্রিকার অভিজাত রাজনীতিক শ্রেণী, এবং সেসব সম্পর্কের সুবিধাও ভোগ করেছে তারাই। সাধারণ জনগণের মতামত বা স্বার্থ ছিল গৌণ।
মে মাসে খবর বেরিয়েছে যে মালিতে বিদ্রোহীদের দমনের অভিযানে, রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার হত্যা ও নির্যাতনে জড়িত ছিল।
ফলে, ফ্রান্সের প্রভাব হ্রাস পেলেই যে পশ্চিম আফ্রিকায় মানুষের ভাগ্য বদলাবে তা বলা যাবেনা।
GIPHY App Key not set. Please check settings