in

লুভর জাদুঘরের অজানা কোণায় একদিন

সাইফুল ইসলাম রনি, প্যারিস

প্যারিসের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লুভর জাদুঘর যেন সময়ের অতল গহ্বর। বিশ্বের বৃহত্তম ও অন্যতম প্রাচীন এই জাদুঘরটির প্রবেশপথে দাঁড়ালেই মনে হয়, ইতিহাস নিজেই তার সত্তা মেলে ধরে অপেক্ষা করছে।

কিন্তু আমি সেদিন যাইনি বিখ্যাত মোনালিসা, ভিনাস দে মিলো বা দ্য উইংড ভিক্টরি অফ সামোথ্রেস দেখতে। আমার উদ্দেশ্য ছিল, লুভরের সেই অজানা, নিরব, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা কোণাগুলোকে খুঁজে বের করা, যেখানে প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থীর চোখ পড়েও থামে না।

কাচের পিরামিড থেকে পাথরের সিঁড়ি

পিরামিড আকৃতির গ্লাস ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অগণন মানুষজনের ভিড় পেরিয়ে আমি এগিয়ে যাই একটি তুলনামূলক কম পরিচিত গ্যালারির দিকে মধ্যযুগীয় খণ্ড। এখানে নেই কোনও আলোকিত চিত্রকর্ম বা নামী ভাস্কর্য। আছে ভগ্নপ্রায় প্রাচীর, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, এবং পাথরে খোদাই করা অলিখিত ইতিহাস। এক গা ছমছমে নিস্তব্ধতায়, যেন সময় থমকে আছে।

এই অংশটা মূলত লুভর দুর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বহন করে, যেখানে ১২শ শতাব্দীতে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্ট একটি প্রতিরক্ষা দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই দুর্গের ভিত্তি এখনো মাটির নিচে দেখা যায়, নিরবে বলে চলে শতাব্দীর পুরোনো গল্প।

ছোট ছোট ঘর, ছায়াময় আলো

প্রবেশ করলাম আরেকটি গ্যালারিতে, মিসরীয় প্রত্নবস্তুর একটি ক্ষুদ্র অংশ, যেখানে আলো-ছায়ার খেলা যেন রহস্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এক কোনায় একটি লেখাযুক্ত মমির কাঠের কফিন, যেখানে প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা মানুষের মৃত্যুর পরজগতের কথা।

কেউ হয়ত এসবের পাশে দিয়ে হেঁটে যায়। কিন্তু আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। এই কাঠের বাক্সে যে একদিন একটা মানুষের শরীর ছিল, যাকে ভালোবাসা হতো, যাকে কাঁদা হয়েছিল, এই ভাবনা এক অদ্ভুত অনুভব এনে দেয়।

মানুষ নয়, সময় কথা বলে

লুভরের অজানা কোণাগুলোয় ঘুরতে ঘুরতে বুঝি, এটা শুধু শিল্পের সংগ্রহশালা নয়, এটা মৌন ইতিহাসের কণ্ঠস্বর। বিখ্যাত চিত্রকর্মের ঝলমলে আলো ছাড়াও এখানে সময় তার নিজের মতো করে কথা বলে।

ছোট ছোট ছায়াঘেরা পথ, কাঠের মেঝে, বিবর্ণ আলোক, কাঠের দড়িতে আটকানো অদ্ভুত প্রত্নবস্তু, এসব যেন এক নীরব নাট্যমঞ্চ। দর্শনার্থীরা আসে, যায়। কেউ দেখে, কেউ দেখে না। কিন্তু তারা থাকে চুপচাপ, এক অনন্ত প্রত্যাশায়।

সন্ধ্যার দিকে, জাদুঘরের গ্যালারিগুলো ধীরে ধীরে নিস্তরঙ্গ হয়ে উঠতে থাকে। ভেতরটা যেন একটু কুয়াশাচ্ছন্ন, আলো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি ফিরে আসি পিরামিডের নিচে, সেই কাচের ছাদটার নিচে, আর একবার পেছনে তাকাই।

আমি জানি, আজ যা দেখেছি তা লুভরের খুব অল্প অংশ। কিন্তু সেটুকু এমন কিছু, যা গাইডবুক বলে না, ক্যামেরা ধরতে পারে না, কিন্তু মনটা সংরক্ষণ করে রাখে আজীবন।

লুভর মানে শুধু বিখ্যাত চিত্র নয়, লুভর মানে নিঃশব্দ ইতিহাস, অজানা করিডোর আর অপ্রকাশিত গল্প। আর সেই গল্পের সঙ্গী হতে চাইলে আপনাকে খুঁজে নিতে হবে সেই অজানা কোণাগুলো, যেখানে সময়, নীরবতা আর শিল্প একত্র হয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIPHY App Key not set. Please check settings