আবার কোনো কোনো বিষয় দেখে ব্যথিত হয়েছি। যেমন সেদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা শুধু খ্রিস্টান ও ইহুদিদের জন্যই রয়েছে বলে মনে হয়েছে। তাদের জন্য প্রচুর গির্জা ও উপাসনালয় থাকলেও মুসলমানদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এমনকি নিজের পছন্দমতো পোশাক পরিধানের ব্যাপারেও তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। ফলে ইসলামিক পোশাক পরিহিতদের প্রায়ই ‘উগ্রবাদী’ শব্দটি শুনতে হয়। অথচ ইউরোপের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হলো ফ্রান্স। যেখানে ৫০ লাখ মুসলমানের বসবাস।
ফ্রান্স ইউরোপের একটি অন্যতম কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। সেদেশে কোনো লোক না খেয়ে মরে না। জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ফ্রান্স সরকারের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য প্রকল্প। যেমন- বেকার ভাতা, পেনশন ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প। বিভিন্ন ধরনের ভাতার ব্যবস্থা থাকায় অনেকেই এর সদ্ব্যবহার করে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যেই এ সুযোগ গ্রহণের প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়।
প্যারিস নগরীতে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃক আয়োজিত একটি বিজনেস সেমিনারে যোগদানের লক্ষ্যে ডেলিগেশনের মেম্বার হিসেবে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। তখনই তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর প্যারিস। রাতের প্যারিস যেন স্বপ্নের মতো। এর সৌন্দর্য অতুলনীয়। পৃথিবীর বিলাসবহুল শহরগুলোর মধ্যে প্যারিস অন্যতম। এ শহরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। কালের সাক্ষী হয়ে অতীত স্মৃতি বহন করছে ছোটবড় বিভিন্ন মিউজিয়াম। গগনচুম্বী অট্টালিকা আর সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট প্যারিসকে মোহনীয় করে তুলেছে। অপরূপ সৌন্দর্যম-িত প্যারিসনগরী বিশ্বের ধনকুবেরদের পছন্দনীয় স্থান। প্যারিসের পারফিউম ভুবনবিখ্যাত। বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে আইফেল টাওয়ারের সীমানা। টাওয়ারের চূড়ায় ওঠার জন্য রয়েছে সুবন্দোবস্ত। অদূরেই অপরূপ সেন নদী, যা প্যারিসকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় মিউজিয়াম ল্যুভর। পৃথিবীর সেরা সব মিউজিয়ামের শহর প্যারিসে, অন্যতম আকর্ষণ ল্যুভর। যা পুরোটা ঘুরে দেখতে সময় লাগে অন্তত চার দিন। প্রতিবছর লাখো পর্যটক প্যারিসে যান এই মিউজিয়ামের মূল্যবান সংগ্রহ দেখতে। আপনি প্যারিস গেছেন কিন্তু ল্যুভর মিউজিয়াম দেখেননি, তাহলে তো জীবনই বৃথা।
ফ্রান্সে বাংলাদেশীদের মোট সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যা ইতোমধ্যে ৫০ হাজার পেরিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। সম্পূর্ণ নিজস্ব চেষ্টায় ভাগ্যান্বেষণে এসে নানা ধরনের কাজ করে তারা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এককথায় বলা যায়, একটি নতুন কমিউনিটি নতুন জেনারেশন, যা গত ২৫ বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নিয়েই যেন তাদের এ পথ চলা। তবে একটি কথা না বললেই নয়। তা হচ্ছে, প্যারিসের মূল সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করাটা খুব কঠিন ব্যাপার। খুব রক্ষণশীল জাতি। তাদের সঙ্গে মিশতে গেলে যে যোগ্যতার প্রয়োজন সে পর্যায়ে বাংলাদেশীরা এখনো পৌঁছাতে পারেনি। যার মূল সমস্যা হলো ভাষা। ফরাসি ভাষা যে কোনো ভাষার চেয়ে কঠিন। ভাষা জানলে ভালো চাকরি এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে উন্নতি করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশীদের মধ্যে সেই মানের ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম। ফ্রান্সে এসেই বাংলাদেশীরা বাস্তবতার কারণে কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে। ভাষাটা আর সেভাবে শেখা হয় না। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এতে সারাজীবনই তাদের কায়িক শ্রমের কাজ করতে হয়। ফলে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় থাকে না। কেবল যারা ভাষাটা শুরু থেকেই আয়ত্তে আনতে পারে, তারাই ভালো করতে পারে। তুলনামূলক ভালো চাকরিও তাদের জন্য সহজ হয়ে ওঠে।
ফ্রান্সে বাংলাদেশী জিনিসের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম। কারণ, সেখানে বাংলাদেশী ফ্লাইট সপ্তাহে মাত্র একবার আসে। অপরদিকে অন্যান্য দেশের ফ্লাইট আসে প্রতিদিন। ফলে তারা সস্তায় তাজা শাক-সবজি থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য জিনিসপত্র দিতে পারে। ফ্রান্সে চাল ও চিংড়ি মাছের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানিরা এসব মার্কেট দখল করে আছে। খাবার জাতীয় জিনিস ছাড়াও ফ্রান্সে বাংলাদেশী রেডিমেড গার্মেন্টসের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সেদেশে বাংলাদেশী পোশাকের যথেষ্ট কদর। কিন্তু সে তুলনায় উদ্যোক্তা ও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। ফ্রান্সের এ বিশাল বাজারে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের পণ্য স্থান করে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের বেশি তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।
বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো কার্যকরী উদ্যোগের অভাব। প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং ও বিপণন কৌশলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের তেমন কোনো দক্ষতা নেই। তাই সব ক্ষেত্রেই বিদেশীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, তাদের এসব বিষয়ে উদ্যোগ অতি সামান্য। কয়েকটি জাতীয় দিবস পালনের মধ্যেই যেন তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিদেশের মাটিতে যতটুকু অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে, তার পুরোটাই প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফসল। ইউরো কারেন্সিতে উপার্জনও ভালো। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা সেভাবে বাড়ছে না।
দুঃখের বিষয়, দেশে প্রিয়জনের নিকট রেমিটেন্স প্রেরণের ব্যাপারে ফ্রান্স তথা প্যারিস নগরীতে তেমন কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রায় সবাই হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ প্রেরণ করে থাকে। তাই প্যারিসে হুন্ডি ব্যবসা জমজমাট। সোনালী ব্যাংকের ওয়েজ আর্নার্স করপোরেট শাখায় চাকরি করার সুবাদে আনোয়ার নামের এক প্রবাসী বাংলাদেশীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যিনি সুদীর্ঘ ১৬ বছর ধরে প্যারিস নগরীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তিনি সেখানে একাধারে কমিউনিটি লিডার, অপরদিকে প্রবাসী বাংলাদেশী মহলে একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। প্যারিসে তার ব্যস্ততম ‘আগপা’ রেস্টুরেন্টে বসে কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, দেশে অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোটা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি রয়েছে অনিশ্চয়তা। যারা হুন্ডি ব্যবসা করে তারা কোনো রসিদ প্রদান তো করেই না, বরং বলে, টাকা পাঠালে পাঠাও, না পাঠালে না পাঠাও। এমন ঝুঁকির মধ্যে বেশ কয়েকবার অঘটনও ঘটে গেছে। টাকা মার গিয়েছে। সে অবস্থায় সেখানে ব্যাংকিং চ্যানেল বা অফিসিয়াল চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুবই জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট রেমিটেন্সের প্রায় ৪০ শতাংশই আসে অবৈধ পথে অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে। এতে দেশ হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি অপরিহার্য। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন ডলার সংকট দেখা দেয়, তখন বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে এলসি খোলা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। যে হারে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে রপ্তানি আয় বাড়ছে না। একমাত্র ভরসা প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় একক খাত হলো রেমিটেন্স আয়। কাজেই হুন্ডিকে প্রতিরোধ করে বৈধপথে রেমিটেন্স আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়া বাঞ্ছনীয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে, যেমন- ইউকে এবং ইতালিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আত্মীয়-স্বজনের নিকট সহজে, দ্রুত ও নিরাপদে প্রেরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেভাবে এক্সচেঞ্জ হাউস স্থাপন করা হয়েছে, ফ্রান্স তথা প্যারিসেও একইভাবে, একই আদলে এক্সচেঞ্জ হাউস স্থাপন করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন হুন্ডির পথ রুদ্ধ হবে, অপরদিকে প্যারিস নগরীতে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বৈধপথে আহরণের পথ সুগম হবে।
লেখক: ড. ইউসুফ খান, ফ্রান্স প্রবাসী বাংলাদেশী
GIPHY App Key not set. Please check settings