দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রশ্নে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তড়িঘড়ি করে সংলাপ শুরু করলেও সংলাপে আসা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ বা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি সাংবিধানিক এই সংস্থা।
সেই সংলাপের দেড় বছর পর এখন আবার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ‘প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ বুঝতে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে ইসি। আগামীকাল বুধবার নির্বাচন ভবনে এ আলোচনা হবে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, ইসির এই উদ্যোগ ভালো। কিন্তু দেড় বছর আগের সংলাপে আসা পরামর্শগুলো ইসির কাছে গুরুত্ব পায়নি। জাতীয় নির্বাচনের মাস চারেক আগে ইসি প্রত্যাশা ও বাস্তবতা বুঝে নিয়ে কতটুকু কী করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। তা ছাড়া আগামী নির্বাচন নিয়ে এখন যে বিতর্ক বা বিরোধপূর্ণ অবস্থান, তা রাজনৈতিক। ইসি বলে আসছে, রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের কিছু করণীয় নেই। তাই শেষ পর্যন্ত ইসির এই উদ্যোগ অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে কতটুকু ফলদায়ক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কেন এই সংলাপ
আগামী ডিসেম্বরের শেষে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চায় ইসি। এর আগে আগামীকাল ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক একটি সেমিনারধর্মী আলোচনার আয়োজন করেছে ইসি। সেখানে চারজন আলোচক, চারজন পর্যালোচক এবং বেশ কয়েকজনকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন মূলত বিশিষ্টজন বিশেষ করে যাঁরা নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমে টক শো বা কলাম লেখার মাধ্যমে সরব, তাঁদের বক্তব্য শুনতে ও বুঝতে চায়। বিষয়ভিত্তিক পাঁচটি আলোচনা আয়োজনের চিন্তা আছে তাদের। প্রথম দিনের আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, তার ওপর বাকি আলোচনাগুলোর আয়োজন করা হবে কি না, তা চূড়ান্ত করা হবে। তবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা ইসির নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার সংলাপে বসার পরিকল্পনাও এখনো নেয়নি তারা।
দেড় বছর আগের সংলাপ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে?
গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কমিশন শপথ নেয়। এরপর গত বছরের ১৩ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। অবশ্য বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সংলাপ বর্জন করে। গত বছরের ৩১ জুলাই সংলাপ শেষ হয়। ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আর তেমন কোনো তৎপরতা নেই। অন্যদিকে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়েও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
গত বছর ইসির সংলাপে অংশ নিয়েছিল সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। আগামীকালের অনুষ্ঠানেও তাঁকে আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইসি। এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেগুলোর বাস্তবায়ন বা ইসির পরিকল্পনার মধ্যে দেখতে পাননি। তারপরও এ মুহূর্তে এ ধরনের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হতে হবে, কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে। ইসি যদি আলোচনা থেকে আসা পরামর্শকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে এটা হবে অর্থহীন আলোচনা।
গত বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর ইসি কয়েকটি বিষয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিল। এ পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলো ছিল, নির্বাচনকালীন সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা, ইভিএমের ব্যবহার, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, রাজনৈতিক মামলা, ইসির ক্ষমতা প্রয়োগ।
ইসি বলেছিল, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। নির্বাচনের সময় কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে ইসির অধীন ন্যস্ত করার বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার বা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনার এখতিয়ার কমিশনের নেই। কিন্তু ইসি যদি মনে করে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না, তাহলে তারা তা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে পারে।
ইভিএম বাদ
ইসির আগের সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। বিশিষ্টজনদের বড় অংশও ইভিএমের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু ইসি দাবি করেছিল বেশির ভাগ দল ইভিএমের পক্ষে। তাই তারা সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে অবশ্য অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ইসি।
সংলাপে ইভিএমে ভিভিপিএটি (এ ব্যবস্থায় একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর প্রিন্ট করা একটি কাগজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে জমা হয়। এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পারেন) যুক্ত করা, ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা, নির্বাচনী ব্যয় বাড়ানো-কমানো, নির্বাচনী ব্যয় তদারক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধানে পরিবর্তন আনা, সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনতে হবে। আরপিও সংশোধন ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, তবে এ বিষয়গুলো সেখানে যুক্ত করার প্রস্তাব ইসির ছিল না।
জালিয়াতি ঠেকাতে ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার সুপারিশও করেছিলেন কেউ কেউ। ইসি নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় সব ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কথা বলেছিল। ইসি বেশ কিছু আসনের উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছিল। সিসিটিভিতে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র দেখে গাইবান্ধা–৫ আসনের ভোট বাতিলও করেছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে সরকারি দলের কোনো কোনো নেতার সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি। এখন ইসি বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা সম্ভব হবে না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নূরুল হুদা কমিশনও রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। সংলাপে পাওয়া সুপারিশগুলোর কোনোটি রাজনৈতিক, কোনোটিকে সাংবিধানিক এবং কোনোটিকে নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছিল হুদা কমিশন। এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ–বিদেশে নানা প্রশ্ন ওঠে।
ইসির এবারের আলোচনায় পর্যালোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ইসির অনুষ্ঠানে যাবেন। সেখানে যাওয়ার আগে কিছু বলতে চান না। তবে এখন নির্বাচন নিয়ে প্রথম যে সমস্যা, সেটা রাজনৈতিক। সেটার সমাধান না হলে অনেক কিছুই হবে না। অন্যদিকে ইসিকে দৃঢ়তা দেখাতে হবে। একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেন, নির্বাচন বন্ধ করা বা এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃঢ়তা কি তারা দেখাতে পারবে?
GIPHY App Key not set. Please check settings