in

ডাকসু নির্বাচন: কী বার্তা দিচ্ছে আমাদের ছাত্র রাজনীতি?

আবু জুবায়ের, প্যারিস

ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ২০২৫-এর ফলাফল শুধু একটি নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনের জয়-পরাজয় নয়, বরং আমাদের জাতীয় রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সমাজের জন্য এক গভীর বার্তা নিয়ে এসেছে।
এই নির্বাচন আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা, তরুণ প্রজন্মের ভাবনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ডাকসুতে ইসলামী ছাত্র শিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর বিজয় একটি বড়ো ধরনের ধাক্কা, যা আমাদেরকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে।


এই বিজয় আমাদের সামনে কিছু কঠিন প্রশ্ন রেখেছে, যার উত্তর খোঁজা এখন অত্যন্ত জরুরি। ডাকসু নির্বাচনের সবচেয়ে বড়ো বার্তা হলো আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভঙ্গুরতা। একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থাকে দুর্বল করে দেয়। নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। ব্যালট পেপার আগে থেকে দাগানো থাকার মতো গুরুতর অভিযোগগুলো প্রমাণ করে যে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা কতটা ব্যর্থ। যখন প্রার্থীরাই নির্বাচনকে ‘লজ্জাজনক কারচুপি’ বলে বর্জন করেন, তখন বুঝতে হবে, আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত কতটা নড়বড়ে। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি বিমুখতা তৈরি করবে। ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো একটি বিতর্কিত সংগঠনের বিজয় প্রশ্ন তুলেছে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম কি রাজনৈতিকভাবে অসচেতন? যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যাদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদ ও সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে, সেই সংগঠনের প্রতি শিক্ষার্থীদের সমর্থন কি তাদের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন? নাকি এটি প্রচলিত ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি গভীর হতাশার ফলাফল?


এই বিজয় হয়তো ইঙ্গিত দেয় যে, জাতীয়তাবাদী , প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের মূল চাহিদা এবং আবেগকে সঠিকভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার কারণেই একটি বিতর্কিত সংগঠন রাজনৈতিক শূন্যস্থান পূরণ করতে পেরেছে। এটি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির জন্য এক বড়ো পরাজয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচলিত রাজনীতির প্রতি যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। ডাকসু নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনের মধ্যে নিরপেক্ষতার অভাব প্রকট। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ অনুযায়ী, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরাসরি ছাত্র শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। যখন প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের কারণে পক্ষপাতিত্ব করেন, তখন তারা নিজেদের পেশাগত নৈতিকতাকে লঙ্ঘন করেন। এই ধরনের আচরণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশকে কলুষিত করে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও অবিশ্বাস বাড়ায়। প্রশাসনের এমন ভূমিকা শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয় এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। এই নির্বাচন থেকে সবচেয়ে বড়ো বার্তাটি হলো উগ্রবাদী রাজনীতির নতুন করে উত্থান এবং প্রগতিশীলতার সংকট।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিজয় কেবল একটি প্রতীকী ঘটনা নয়, এটি শিক্ষাঙ্গনে ধর্মীয় বিভাজন ও উগ্রবাদের রাজনীতিকে বৈধতা দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ রক্ষার লড়াই চালিয়ে আসছে। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিল, তাদের সেই লড়াই এখনও অসম্পূর্ণ। উগ্রবাদী শক্তিগুলো নতুন নতুন কৌশল নিয়ে আবারও শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এটি দেশের ভবিষ্যৎ এবং প্রগতিশীল সমাজ গঠনের জন্য এক বড়ো হুমকি। যদি এই ধারা চলতে থাকে, তবে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র না হয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় হানাহানির আখড়ায় পরিণত হবে। ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ আমাদের সামনে কয়েকটি কঠিন প্রশ্ন রেখেছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কি এতটাই দুর্বল? তরুণ প্রজন্ম কি রাজনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না? প্রশাসনের নিরপেক্ষতা কি কেবলই মুখের বুলি? এবং সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, আমরা কি শিক্ষাঙ্গনে উগ্রবাদের উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব? এই নির্বাচন একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল ছাত্র সমাজকে এখন এক হয়ে কাজ করতে হবে। এই বার্তাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং জাতীয় রাজনীতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIPHY App Key not set. Please check settings