ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর উত্তরায় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হামলায় ৯২ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স নামের একটি সংগঠন এ তথ্য জানায়। বেলা দেড়টায় উত্তরার ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সংগঠনের মুখপাত্র ফান্তাসির মাহমুদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান, সদস্যসচিব ফয়সাল মাহমুদ, যুগ্ম আহ্বায়ক আহমদ সামরান এবং উত্তরায় ১০ জন শহীদের স্বজনেরা।
ফান্তাসির মাহমুদ বলেন, ‘ঢাকায় সবচেয়ে বড় ও সাংঘর্ষিক আন্দোলন হয়েছিল উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায়। অনেকে বলেন, ৫ আগস্ট উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী থেকে মিছিল না গেলে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হতো না। উত্তরায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। আমরা সেসব শহীদের স্মৃতি বা অবদান তুলে ধরতে শহীদদের একটি তালিকা তৈরির কাজ করছি। এখন পর্যন্ত আমরা উত্তরায় ৯২ জন শহীদ হওয়ার খবর পেয়েছি। আমাদের এ কাজ চলমান।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা মিলে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স নামের এই সংগঠন গড়েছেন। এর কার্যক্রম শুরু হয় গত সেপ্টেম্বরে। সংগঠনটি একটি ওয়েবসাইটও চালু করেছে। শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ও অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হবে এই ওয়েবসাইটে।
‘বেশি নিহত ৫ আগস্ট’
জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্সের তালিকা অনুযায়ী, শহীদদের মধ্যে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি, ২৫ জন। এ ছাড়া চাকরিজীবী ১৯ জন, ১০ জন ব্যবসায়ী, ৫ জন পরিবহনচালক, ২ জন ইমাম, ১ জন চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশার ১৯ জন। তবে ১১ জনের পেশার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সংগঠনটির দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন গত ৫ আগস্ট উত্তরায় সবচেয়ে বেশি ৪২ জন শহীদ হন। এ ছাড়া ১৮ জুলাই ২০ জন, ১৯ জুলাই ২২ জন, ৪ আগস্ট ৭ জন ও ৭ আগস্ট ১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
তালিকা তৈরির বিষয়ে ফান্তাসির মাহমুদ বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই কেবল তালিকায় শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। পরে মুঠোফোনে বা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শহীদদের তথ্য নিশ্চিত হয়েছি। এর মধ্যে নিহত ১১ জনের তথ্য আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। এ ব্যাপারে আমাদের কাজ চলছে।’
এদিকে গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উত্তরার মুগ্ধ মঞ্চ এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তরায় শহীদদের একটি তালিকা প্রকাশ করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের অভিভাবকদের উত্তরা নামের একটি সংগঠন। সেখানেও উপস্থিত ছিলেন শহীদ পরিবারের কয়েকজন। শহীদদের ছবিসহ তালিকাটি মুগ্ধ মঞ্চে স্থাপন করা হয়। সংগঠনটির তালিকা অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে উত্তরায় ৪৬ জন শহীদ হয়েছেন।
শহীদদের নিয়ে দুই তালিকার তথ্যে তারতম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির সদস্য মনীষা মাফরুহা বলেন, ‘আমরা মাইকিং করে, সরকারি ওয়েবসাইটের তালিকা থেকে বা যাঁরা (শহীদদের স্বজনেরা) আমাদের এখানে এসে তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে আমরা এই তালিকা প্রস্তুত করেছি। আমরা ওই তালিকার (জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স) বিষয়ে জানতাম না। তাদের তালিকার সঙ্গে আমাদের তালিকা যাচাই করে দেখা হবে, কোথায় তারতম্য হলো।’
স্মৃতিচারণায় কাঁদলেন শহীদদের স্বজনেরা
১৯ জুলাই দুপুরে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য বাসা থেকে বের হন উত্তরার বাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা গাড়িচালক মো. আসাদুল্লাহ। কথা ছিল নামাজ শেষে বাসায় ফিরবেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হবেন; কিন্তু এরপর আর বাসায় ফেরেননি আসাদুল্লাহ। তাঁর শিশুসন্তান আলভী ও আলিফা এখনো বাবার অপেক্ষায়।
স্বামীর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারজানা। তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই আন্দোলেনে গিয়ে আমার স্বামী পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। আমার ছোট দুইটা ছেলে-মেয়ে। এখনো তারা বাবার আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। তারা প্রতিদিন তাদের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে; কিন্তু আমি তাদের কোনো উত্তর দিতে পারি না। পৃথিবীর বুকে এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কিছুই হতে পারে না!’
১৯ জুলাই উত্তরায় গুলিতে প্রাণ হারায় নিজ বাসার বারান্দায় খেলতে থাকা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমা সুলতানা। মেয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তার মা আইনুন্নাহার বলেন, ‘বাসায় থেকেও আমার মেয়েটা বাঁচতে পারল না। আমি চাই, আমার মেয়ের মতো প্রত্যেক শহীদের ঘটনা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিগত সরকারের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে জানতে পারে।’
GIPHY App Key not set. Please check settings