in

কেন বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য

লেখক: সাইফুল ইসলাম রনি, প্যারিস

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যম নয়, বরং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দৃঢ় করার একমাত্র উপায়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে, যখন কোনো নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক শক্তিকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এবং দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ধাবিত হয়েছে। এই বাস্তবতায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—সব দলের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করা যাবে।

গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত হলো জনগণ যেন স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিনিধিকে বেছে নিতে পারে। যদি বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির মতো প্রধান রাজনৈতিক শক্তি কোনো কারণে নির্বাচনের বাইরে থাকে, তবে সেই নির্বাচনকে কখনোই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য ধরা হবে না। জনগণের আস্থা হারানো নির্বাচনের ফলে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা থমকে যাবে।

রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সব দলের অংশ গ্রহণ প্রয়োজন।বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি প্রধান শক্তি—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের বাইরে জামায়াত ইসলাম, জাতীয় পার্টিও একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয়। যদি এসব মূলধারার দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হয়, তবে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তখন চরমপন্থী, কট্টর ডানপন্থী বা মৌলবাদী দলগুলো রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করবে, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে।

অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, যখনই কোনো দল এককভাবে বা প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে এবং দমন–পীড়নের সংস্কৃতি বেড়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, যেখানে সব দল অংশ নেবে। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ দলগুলোকে জনগণের কাছে জবাবদিহি হতে বাধ্য করবে। পাশাপাশি অতীতে যারা গণতন্ত্রকে খর্ব করেছে বা জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করেছে, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা সহজ হবে।

বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র। কিন্তু গত কয়েক দশকে বারবার দেখা গেছে, বড় দলগুলো নিজেদের স্বার্থে কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে বাদ দেওয়ার কৌশল নিয়েছে। এর ফলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে এবং জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে কেবল তখনই জনগণ মনে করবে যে তাদের ভোট সত্যিকার অর্থে মূল্যবান। এটি গণতন্ত্রে আস্থা পুনর্গঠনে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের নির্বাচন শুধু দেশীয় রাজনীতির বিষয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি থাকে এ প্রক্রিয়ার দিকে। উন্নয়ন সহযোগী, বৈদেশিক বিনিয়োগকারী ও আঞ্চলিক কূটনৈতিক মহল—সবাই একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। যদি প্রধান দলগুলো অনুপস্থিত থাকে, তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্থনৈতিক–কূটনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গণতন্ত্রের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। যদি এ নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করে, তবে তা হবে তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা যে গণতন্ত্র মানে প্রতিযোগিতা, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা। অন্যদিকে, একতরফা নির্বাচন তরুণদের মনে রাজনৈতিক অনীহা ও অবিশ্বাস তৈরি করবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাদ দিয়ে কখনো গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। বরং এতে রাজনৈতিক বিভক্তি, সহিংসতা ও অস্থিরতা বেড়েছে। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ইসলাম, জাতীয় পার্টি সহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা শুধু সময়ের দাবি নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষার একমাত্র উপায়। প্রতিপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করার মানসিকতা দেখাতে পারলেই কেবল বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক যাত্রাকে টেকসই ও গ্রহণযোগ্য পথে এগিয়ে নিতে পারবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

GIPHY App Key not set. Please check settings