সরকারকে জেতাতে নির্বাচন কমিশন কোনো দস্তখত করে ফেলেনি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারেনি। জনগণ ধারণা করে, সরকারকে জেতাতে ইসি দস্তখত করে ফেলেছে। এতটা কাউয়ার্ড (কাপুরুষ) হইনি। এতটা নৈতিকতা বিবর্জিত হইনি।’
আজ বুধবার ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক কর্মশালায় সিইসি হাবিবুল আউয়াল এসব কথা বলেন। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতা বুঝতে বিশিষ্টজনদের নিয়ে এই কর্মশালার আয়োজন করে ইসি। সেখানে চারজন আলোচক, চারজন পর্যালোচক এবং বেশ কয়েকজনকে অতিথি অংশ নেন।
কর্মশালায় পর্যালোচক হিসেবে বক্তব্য দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি হুমায়ুন কবির। তিনি তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীর মাধ্যমে ইসি নিজেদের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে। আরপিও সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন নিজেদের ক্ষমতা কেন কমাল। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সিইসির সক্ষমতা আরও বাড়বে। ইসির ক্ষমতা বাড়ার বদলে কমেছে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ।
এই বক্তব্যের মাঝখানেই কথা বলতে শুরু করেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সক্ষমতা কমিয়েছি, এটা সম্পূর্ণ অপপ্রচার। গণমাধ্যমের একটি বিষয় থাকে, ইসিকে খাটো করে দেখানো। জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। সারা দেশে প্রচার হচ্ছে, ইসি নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। ইসি মাথা নিচু করে সরকারের পক্ষে চলে গেছে, এটা মোটেই সত্য নয়।’
সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনের পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদন চোখ বন্ধ করে গেজেট করার বিধান ছিল। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদন স্থগিত রেখে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে। অনেক সময় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা পেশিশক্তির কারণে কেন্দ্রে অসহায় হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতি হলে তিনি পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ডাকবেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে কেন্দ্র থেকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা চলে আসতে পারবেন। জনগণের মতের প্রতিফলন হবে না, পরিস্থিতি এমন হলে কেন্দ্র ত্যাগ করে চলে আসতে পারবেন।
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারেনি। সাধারণের ধারণা, সরকারকে জেতাতে দস্তখত করে ফেলেছে। এতটা কাউয়ার্ড (কাপুরুষ) হইনি। নৈতিকতা বিবর্জিত অতটা হইনি।’
সকালে নির্বাচন ভবনে শুরু হওয়া কর্মশালা টানা তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে। এতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, সাবেক সচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূত, সম্পাদক, সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা অংশ নেন। তাঁরা নির্বাচন নিয়ে তাঁদের প্রত্যাশা, বাস্তবতা তুলে ধরেন।
‘কঠিন অবস্থায় আছি’
বিশিষ্টজনদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। আমরা একটা কঠিন অবস্থায় আছি। এটা বিলেতের নির্বাচন হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন হচ্ছে না। সংকট আছে, আপনারা বলেছেন, আমরাও অনুধাবন করি। সেই অনেকগুলো সংকট নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। কথাটি বারবার বলেছি—আমাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ রাজনীতিবিদেরা যদি তৈরি করে না দেন, তাহলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করাটা কষ্টসাধ্য হবে। আর পরিবেশ অনুকূল করে দেন, আমাদের জন্য কাজটা সহায়ক হবে।’
‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। ঢাকা, ১৩ সেপ্টেম্বরছবি: প্রথম আলো
রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর
হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনটা ভালো হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে ‘পলিটিক্যাল উইল’-এর (রাজনৈতিক সদিচ্ছা) ওপর। তিনি বলেন, ‘আন্তরিক পলিটিক্যাল উইল থাকতে হবে। এটা আমার থেকে আসবে না। রাজনীতি থেকে আসতে হবে বা সরকার থেকে আসতে হবে।’
সরকার ও দলকে সব সময় তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয় বলে মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘বিভাজনটা বুঝতে হবে। সরকার ও দল ভিন্ন জিনিস। সরকারি দল বলতে কোনো শব্দ সংবিধানে নেই। এটা হয়তো মুখে বলে থাকি। যখনই একটা সরকার হয়ে যাবে, তখন সে সব দলের, সব জনগণের, পুরো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে।’
সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা
সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখার কথা জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আশ্বস্ত বোধ করছি। সরকারের তরফ থেকে ইদানীং বারবার বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে চায়। এ প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছে। এর আগে কিন্তু সরকার কখনো এ প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এই প্রথমবারের মতো সরকার এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী—উনারা ‘সরকার’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও স্পষ্টভাবে কয়েকবার বলেছেন, সরকার আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আমি বলব, আস্থা রাখতে চাই।’
‘আপনারা চায়ের টেবিলে বসেন’
নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, একটা সমঝোতার কথা। আপনারা চায়ের টেবিলে বসেন। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন হয়েছে, কেউ কারও সঙ্গে বসতে চাচ্ছেন না। ইসি এ সমস্যার সমাধান করে না। দেশজ পদ্ধতিতে এটা (সমাধান) হতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক, সে ধরনের সুশীল সমাজ দেখতে পাচ্ছি না।’
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘অনেকে প্রত্যাশার কথা বলেছেন, সেগুলো পূরণ করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু ইসির কর্মপরিধি ও ক্ষমতা সেটি আইন ও সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। রাজনৈতিক ইস্যুগুলো রাজনৈতিক নেতাদের সমাধান করতে হবে।’
GIPHY App Key not set. Please check settings