জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, নিহতদের রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া, আহতদের সুচিকিৎসায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের জন্য জোর দিতে বলেন।
এছাড়া গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা।
প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘খুচরাভাবে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আগে দেখা হয়েছে। আজকে অনেকের সাথে দেখা হলো। ভালো হলো। তোমাদের কথা শুনতেই মূলত আজকে বসা। তোমরা সরকারের কাছে কী চাচ্ছো, আশাগুলো কী, পরামর্শ আছে কি না কোনো এটি জানতে চাওয়া।’
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, ‘তোমরা রাষ্ট্রের অভিভাবক, তোমাদের কারণেই রাষ্ট্র। এই ভূমিকা ভুলে যেও না। নিজেদের ভূমিকা ভুলে যেও না। অনেকে এখানে আছে, অনেকে নেই। যারা নেই, তারাও রাষ্ট্রের অভিভাবক। তোমাদের দায়িত্ব আছে রাষ্ট্র যেন ঠিক পথে চলে, যেন বিচ্যুত না হয়। এইটুকু মনে রাখলে রাষ্ট্র ঠিক থাকবে। নিজের অভিভাবকতত্ব ভুলে যেও না।’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরামর্শকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য ঠিক থাকতে হবে। সিন্ডিকেট নাকি কী এই ধরনের ব্যাখ্যা আমরা চাই না। কতগুলো লোক বাজারমূল্য কবজা করে থাকবে সেটা হতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি দ্রব্যমূল্য ঠিক রাখার। আমরা দ্রব্যমূল্য স্টেবল রাখতে চাই। রমজানেও দ্রব্যমূল্য স্টেবল রাখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। হঠাৎ করে যেন কোনো পরিস্থিতি না হয়।’
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পরামর্শে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য কমিশন আছে। তারা পরামর্শ দেবে আমরা কাজ করব। আমরা চাই স্থানীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। খুব কম জিনিস উচ্চ পর্যায়ে থাকবে। দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম, একবার একটা ফান্ড বানিয়ে দিলে কারা যেন খেয়ে ফেলে। সেজন্য সুশৃঙ্খলভাবে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন স্থায়ী হয়।’
জুলাইয়ে শহীদদের রাষ্ট্রীয় সম্মান ও খেতাবের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পরামর্শে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। জুলাইয়ে যারা শহীদ হয়েছে তাদের অবদান আমরা ভুলব না। তাদেরকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হবে।’
শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের এমন পরামর্শের প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। যেন বাংলাদেশে কেউ শিক্ষিত না হয়ে উঠতে পারে, দক্ষ হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে এটা হয়েছে। বেকারত্ব তৈরি করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জন কিছু নেই। এটা আমদের ঠিক করতে হবে। তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থার করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। প্রধান উপদেষ্টা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমাদের অর্থনীতি বিভাগে নারী শিক্ষার্থী ছিল মাত্র চারজন। তোমরা বলছো, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থী প্রায় ৫২ শতাংশ। এটি অত্যন্ত আনন্দের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে আগে সিট বন্টন হতো সেই দাসপ্রথা এখন ভেঙে গেছে। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।’
আজকের মতবিনিময়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বারবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গণমাধ্যমে সরকারের কাজ সঠিকভাবে প্রচার না হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। শিক্ষার্থীদের এমন বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে সরব এটা ঠিক। সরকারের নিজের কোনো পত্রিকা নেই। আছে শুধু প্রেস উইং। তারা পত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠায়। কেউ ছাপে, কেউ ছাপে না কিংবা তাদের মনমতো শেষ পাতায় বা কোণায় ছোট করে দেয়।
প্রেস উইং ওদের মতো করে চেষ্টা করছে, কাজ করছে। সরকার কোনো গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করবে না। সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে কাজ করবে-এটাই আমাদের নীতি। আমরা এই নীতিতে থাকব। আমি বুঝতে পারছি তোমরা কিছুটা মনক্ষুণ্ণ। এটা আসলে কিছুটা মন খারাপ হওয়ার মতো যে সরকারের কাজ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পুরো সিস্টেমটাই ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। চারদিকে চুরি-চামারি, ব্যাংক কাজ করে না। কমিটি অর্থনীতির শ্বেতপত্র দিয়েছে। আমি বলেছি, এটা একটা ঐতিহাসিক দলিল। আমি মনে করি এটা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো উচিত। দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার দায় আওয়ামী লীগের। তবে যারা উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে তাদেরও ধরতে হবে।’
‘যে ধ্বংসস্তুপ রেখে গেছে সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। যেদিকে হাত দেই সেদিকেই ভাঙাচোরা। এই ভাঙাচোরা পরিষ্কার করেই যাচ্ছি। কাজ শুরু করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।’
শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে সংস্কারকাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তারা জানান, দেশের মানুষ সরকারের পাশে আছে। এটি গণমানুষের সরকার। জনগণ চায় অন্তর্বর্তী সরকার যেন প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজটি সম্পন্ন করে।
প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘দেশের মানুষ ছাত্রদের ওপর ভরসা করে। এই বিশ্বাস ধরে রেখো। হাতছাড়া করো না। তোমরা কখনোই আশাহত হবে না। তোমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছ। দেশ বদলিয়ে ফেলেছ। তোমরাই পারবে। মানুষের আশা তোমাদের পূরণ করতে হবে। অন্তত সে পথে তোমাদের অগ্রসর হতে হবে। এক বিজয় করেছো, আরেক বিজয় আসবে। তোমরা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেবে যেন আমরাও সতর্ক হই, সজাগ হই।’
GIPHY App Key not set. Please check settings